Dawatul Islam | কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও আধুনিক সমাজে এর বাস্তবায়ন ভূমিকা

বুধবার, ২৯, অক্টোবর, ২০২৫ , ১৪ কার্তিক ১৪৩২

কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও আধুনিক সমাজে এর বাস্তবায়ন ভূমিকা
২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১০:০০ মিনিট

মানবজাতির শান্তি, ন্যায়বিচার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআন শুধু ইবাদতের বিধান নয়, বরং মানবজীবনের প্রতিটি দিক—ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দেয়। তাই কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠা মানে হলো জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা। আজকের আধুনিক বিশ্বে যেখানে অন্যায়, দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় দিন দিন বাড়ছে, সেখানে কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠা মানবতার পরিত্রাণের একমাত্র পথ।


১. কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব

(ক) আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বীকার

কুরআনের আইন বাস্তবায়নের প্রথম শর্ত হলো আল্লাহকে একমাত্র হাকিম বা শাসক হিসেবে মেনে নেওয়া। আল্লাহ বলেন,

যারা আল্লাহ নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই কাফির।”
(
সূরা মায়িদা ৫:৪৪)

এ আয়াত স্পষ্ট করে যে আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কোনো আইন মানুষের স্বাধীনভাবে তৈরি করা ইসলামী দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।

(খ) মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা

কুরআন কেবল নামাজ-রোজার নির্দেশনাই দেয়নি, বরং সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, পারিবারিক সম্পর্ক—সব কিছুর নীতিমালা দিয়েছে।
আল্লাহ বলেন,

আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যাতে প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা, হেদায়াত ও রহমত থাকে।”
(
সূরা নাহল ১৬:৮৯)

অতএব, কুরআন হলো মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান।

(গ) ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা

কুরআনের আইন ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
আল্লাহ বলেন,

আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন, তোমরা আমানত তাদের নিকট পৌঁছে দাও যারা তার হকদার এবং মানুষের মধ্যে বিচার করো ন্যায়ের ভিত্তিতে।”
(
সূরা নিসা ৪:৫৮)

(ঘ) মানব কল্যাণ ও সুরক্ষা

কুরআনের বিধান মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে—ধর্ম, জীবন, বংশ, বুদ্ধি ও সম্পদ। হত্যা, চুরি, ব্যভিচার, মদ ও জুয়া—সবকিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে মানবকল্যাণের জন্যই।

(ঙ) দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা

আল্লাহ বলেন,

যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মান্য করো, তবে তিনি তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন
(
সূরা আহযাব ৩৩:৭১)

সুতরাং কুরআনের বিধান মানা কেবল দুনিয়ার শান্তির জন্য নয়, আখিরাতের মুক্তিরও পথ।


২. ইতিহাসে কুরআনের আইন বাস্তবায়ন

(ক) রাসূলুল্লাহ এর যুগে

মক্কা পর্বে:
নবী করিম প্রথমে মানুষকে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস ও চরিত্র সংশোধনের দাওয়াত দেন। তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা না থাকলেও মানুষের মন-মানস গড়ে তোলা হয় কুরআনের ভিত্তিতে।

মদীনা পর্বে:
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর কুরআনের আইন ধাপে ধাপে কার্যকর করা হয়—

  • মদীনার সনদ প্রণয়ন
  • নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ ফরজ করা
  • পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও দণ্ডবিধি আইন প্রবর্তন
  • ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা

ফলে মদীনা রাষ্ট্রে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, দুর্বলদের অধিকার রক্ষা পায়, মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে।

(খ) খোলাফায়ে রাশেদীন যুগে

  • আবু বকর (রাঃ)ইসলামী অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষায় মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
  • উমর (রাঃ)ন্যায়বিচার, প্রশাসন সংস্কার ও দারিদ্র্য দূরীকরণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
  • উসমান (রাঃ)কুরআনকে একত্রে সংকলন করেন।
  • আলী (রাঃ)বলেন: “রাষ্ট্র কুফরের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু জুলুমের মাধ্যমে কখনো না।”

এই যুগে কুরআনের আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, যা পরবর্তী মুসলিম শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি গঠন করে।


৩. পরবর্তী খিলাফতসমূহে ইসলামী আইন

উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানীয় খিলাফতএই তিন যুগে শরীয়ত ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি।

  • বিচারব্যবস্থা, করনীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতি সবই কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক ছিল।
  • উসমানীয় খিলাফতের অধীনে ছয় শতাব্দী ধরে শরীয়াহ আদালত কার্যকর ছিল এবং অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছিল।

ইতিহাস প্রমাণ করে, কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠিত থাকলে সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার বিরাজ করে; আর যখন তা থেকে বিচ্যুতি ঘটে, তখন অরাজকতা ও ধ্বংস নেমে আসে।


৪. আধুনিক সমাজে কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন

আজকের সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি, মাদক, পারিবারিক ভাঙন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এসব সমস্যা কুরআনের আইনের মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব।

  • নৈতিক সংকট মোকাবিলা:কুরআনের শিক্ষা মানুষকে আল্লাহভীরু করে তোলে।
  • অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার:সুদমুক্ত অর্থনীতি ও যাকাতের ব্যবস্থা বৈষম্য কমায়।
  • পারিবারিক স্থিতিশীলতা:বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় কুরআনের নির্দেশ পরিবারে শান্তি আনে।
  • রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার:কুরআনের আইন সকল নাগরিকের জন্য সমান বিচার নিশ্চিত করে।

৫. বাংলাদেশে কুরআনের আইন বাস্তবায়নের ধাপসমূহ

ধাপ ১: ব্যক্তি ও পরিবারে কুরআনের অনুশীলন

ব্যক্তিগত জীবনে নামাজ, রোজা, যাকাত আদায়; হালাল উপার্জন ও চরিত্র গঠন।
পারিবারিক জীবনে নারী-পুরুষের অধিকার রক্ষা ও উত্তরাধিকার ন্যায্যভাবে বণ্টন।

ধাপ ২: সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা

দান-সদকা, প্রতিবেশীর অধিকার, মাদক ও জুয়া থেকে সমাজকে মুক্ত করা।

ধাপ ৩: শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সংস্কার

নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, মিডিয়ায় অশ্লীলতা রোধ ও কুরআনভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

ধাপ ৪: অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন

সুদমুক্ত ব্যাংকিং, যাকাত কার্যকরকরণ, হালাল বাণিজ্য উন্নয়ন।

ধাপ ৫: বিচার বিভাগে শরীয়াহর প্রয়োগ

পারিবারিক আইন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে শরীয়াহভিত্তিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।

ধাপ ৬: রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পূর্ণ বাস্তবায়ন

সংবিধানে কুরআন ও সুন্নাহকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা, প্রশাসন ও অর্থনীতিকে শরীয়াহভিত্তিক করা।


৬. চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

চ্যালেঞ্জ:

  • রাজনৈতিক বিভক্তি ও দুর্নীতি
  • ইসলামী আইন সম্পর্কে ভুল ধারণা
  • আন্তর্জাতিক চাপ ও ঔপনিবেশিক আইন কাঠামো

সমাধান:

  • দাওয়াহ ও সচেতনতা বৃদ্ধি
  • ধাপে ধাপে সংস্কার বাস্তবায়ন
  • জনগণের অংশগ্রহণ ও ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্ব গঠন

উপসংহার

কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠা কোনো একক রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম নয়, এটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া—ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। কুরআনের আইন মানবজাতিকে ন্যায়, শান্তি ও নিরাপত্তার পথে পরিচালিত করে। তাই আজকের বিশ্বে কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠা শুধু ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের একমাত্র উপায়।

 

সব সংবাদ