কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও আধুনিক সমাজে এর বাস্তবায়ন ভূমিকা

পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ আজ ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। আজ সমাজে এ সংখ্যা মোটেও কম নয়। আমরা এই দেশে ইসলামী সমাজের স্বপ্ন দেখছি। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমরা প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি— এদেশ গড়ার কারিগরদের গড়ে তুলতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রস্তুত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের বিশ্বাস, প্রকৃত অর্থে এই গুণগুলোর সমন্বয় সাধনের জন্য ইসলামী আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হওয়ার বিকল্প নেই। আর আখিরাতের মুক্তির ক্ষেত্রেও এ পথ ছাড়া উপায় নেই।
এ প্রজন্মকে ইসলামী আন্দোলনের দিকে আহ্বান জানাতে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের বিভিন্ন জ্ঞানসমৃদ্ধ উদ্যোগ ইতিমধ্যেই কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এসব প্রচেষ্টার পাশাপাশি আজ আমি একটি ছোট, সহজ কিন্তু অত্যন্ত ফলপ্রসূ দাওয়াতি মাধ্যম নিয়ে কথা বলতে চাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস— আমরা যারা ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয়, যদি এই বিষয়টি সচেতনভাবে গ্রহণ করি, তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারব ইনশাআল্লাহ।
এই মাধ্যমটি হলো —পরবর্তী প্রজন্মকে সচেতনভাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া।
আমরা সবাই ছাত্র বা তরুণ কর্মী। আমাদের “পরবর্তী প্রজন্ম” বলতে বোঝাচ্ছি আত্মীয়স্বজনের মধ্যে আমাদের জুনিয়রদের— যেমন সহোদর ছোট ভাই-বোন, চাচাতো, মামাতো, খালাতো ভাইবোন, তাদের সন্তান ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকের ওপর আমাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সামান্য প্রচেষ্টাতেই এই প্রভাব আরও গভীর ও ইতিবাচকভাবে বিস্তৃত করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন একটু সচেতনভাবে পথ চলা।
ধরা যাক, বড় খালাতো বোন তার ছয় বছরের সন্তানকে পড়াতে বসান। উৎসাহ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “ভালো করে পড়, তোমার নাসির মামার মতো হতে হবে।” এই কথাটিই শিশুটির মনে নাসির মামার একটি আদর্শ চিত্র গড়ে তোলে। সে অবচেতন মনে মামাকে অনুসরণ করতে চায়। এখন যদি সেই নাসির মামা নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, উপহার পাঠান, সময় বের করে দেখা করেন, চিঠি লেখেন, পড়ালেখার খোঁজ নেন, খেলাধুলায় উৎসাহ দেন, গল্প করেন, বেড়াতে নিয়ে যান এবং নিজেকে সত্যিকার আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালান— তাহলে নিশ্চিতভাবেই ভাগ্নে বা ছোট আত্মীয়রা তাকে অনুসরণ করবে।
এভাবে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছোটদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুললে তাদের মধ্যে ইতিবাচক ও ইসলামী মূল্যবোধ সহজেই প্রতিষ্ঠিত করা যায়। নামাজ, রোজা, ভালো আচরণ, অধ্যবসায়— সবকিছুতেই তারা বড়দের অনুকরণ করতে শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে ইসলামী চেতনা দৃঢ় হয়, এবং তারা ইসলামী আন্দোলনের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট হয়।
আমি এই চিন্তা থেকেই একবার একটি অনলাইন জরিপ করেছিলাম। ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ৭৫ জন ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: “আপনার আত্মীয়দের মধ্যে আপনার চেয়ে ছোট— সহোদর ভাইবোন, কাজিন, তাদের সন্তান ইত্যাদি— এমন জুনিয়রদের সংখ্যা কত?” গড়ে প্রতি ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২২.৫ জন! অর্থাৎ, সামান্য সচেতনতা ও প্রচেষ্টায় প্রতিজন কর্মী তার আশপাশের অন্তত ২০-২৫ জন তরুণের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেন।
ভাবুন, যদি প্রত্যেক কর্মী এমন সচেতনভাবে কাজ করেন, তবে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের প্রায় প্রতিটি মুসলিম শিশু ও তরুণ এই নীরব দাওয়াতের আওতায় চলে আসবে ইনশাআল্লাহ।
সম্প্রতি আমার বড় ভাতিজার এসএসসির ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, সে অসাধারণ ফলাফল করেছে। আমি গভীর আনন্দে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছি। উপলব্ধি করেছি— আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যখন আমাদের চেয়ে ভালো করে, তখন আনন্দও বহুগুণে বেড়ে যায়। আমরা যেমন আমাদের বড়দের দেখে উদ্বুদ্ধ হতাম, তেমনি আমাদের ভাতিজা-ভাগ্নে-ছোট ভাইবোনরাও আমাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়। এই প্রজন্ম যদি দ্বীনি ও দুনিয়াবি যোগ্যতায় আরও উন্নত হয়, তবে তারা ইনশাআল্লাহ শান্তির সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
এভাবে এক ধৈর্যশীল, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা একটি নীরব কিন্তু কার্যকর বিপ্লবের সূচনা করতে পারি— এমন একটি বিপ্লব, যা সমাজকে আলোকিত করবে ইসলামী চেতনায়, নৈতিকতায় ও মানবিকতায়।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো, যার জ্বালানি মানুষ ও পাথর।” —(সূরা আত-তাহরিম: ৬)
এই আয়াতের নির্দেশ বাস্তবায়নের একটি বাস্তব পথ হতে পারে— আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ঈমান, আদর্শ ও নৈতিকতায় গড়ে তোলা।
আসুন, আমরা তরুণ সমাজের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের আত্মীয়-পরিজন, ছোট ভাইবোন ও পরবর্তী প্রজন্মকে ভালো মানুষ, দায়িত্বশীল নাগরিক এবং দ্বীনের পথে অগ্রসর কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা করি। সচেতনভাবে এদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুললে একদিন ইনশাআল্লাহ এ জাতি হবে শান্তিময় সমাজের ধারক-বাহক।
এটাই হবে একনীরব বিপ্লবের হাতছানি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দিন, কবুল করুন।
লেখক:সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
সূত্র: shibir.org.bd