Dawatul Islam | মানবিক রাজনীতির নতুন ধারা: জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি

বুধবার, ২৯, অক্টোবর, ২০২৫ , ১৪ কার্তিক ১৪৩২

মানবিক রাজনীতির নতুন ধারা: জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি
২৫ অক্টোবর ২০২৫ ১০:১৮ মিনিট

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্ষমতার রাজনীতি, দলীয় স্বার্থ আর প্রতিহিংসার সংস্কৃতি বহু পুরনো। এই কাঠামোর মধ্যে সাধারণ মানুষ বহুবার প্রতারিত হয়েছে, হারিয়েছে তাদের মৌলিক অধিকার ও ন্যায্য প্রাপ্য। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে যখন রাজনীতিকে “মানবসেবার দায়িত্ব” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা দেখা যায়, তখন সেটি নিঃসন্দেহে নতুন এক চিন্তাধারার সূচনা। জামায়াতে ইসলামী সেই ধারাটির প্রতিনিধিত্ব করছে— যেখানে রাজনীতি মানে ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং মানবতার সেবা, নৈতিক নেতৃত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতা।

রাজনীতি নয়, মানবতার অঙ্গীকার

জামায়াতে ইসলামী নিজেকে কেবল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়, বরং একটি মানবিক সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। দলটির বক্তব্য— “মানবিক সংগঠন ব্যতীত মানবিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়।” এই চিন্তায় নিহিত রয়েছে এক গভীর দৃষ্টিভঙ্গি: রাষ্ট্র গঠনের মূলে যদি মানবিকতা না থাকে, তাহলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না।

দলটি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, এবং যুব উন্নয়নসহ সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিশেষ করে দুর্যোগ, বন্যা বা নদীভাঙনের সময় জামায়াতে ইসলামী যে ধরনের মানবিক সহায়তা দিয়ে থাকে, তা প্রমাণ করে তারা রাজনীতিকে মানবকল্যাণের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে চায়।

বৈষম্যহীন সমাজের প্রত্যাশা

জামায়াতে ইসলামী যে সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে, সেটি হলো বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক ও নৈতিকতাসম্পন্ন বাংলাদেশ। দলটির নীতিমালায় বলা হয়েছে, রাজনীতির লক্ষ্য হলো এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি নাগরিক সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারে এবং কেউ আর্থিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কারণে বঞ্চিত না হয়।

এই বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ধারণা কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়; বরং এটি একটি নৈতিক দর্শন। দলটি বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রের প্রতিটি নীতি ও সিদ্ধান্ত মানুষের কল্যাণের দিকে নিবদ্ধ থাকতে হবে। কারণ, নাগরিক কল্যাণই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা: মানবিক রাষ্ট্রের ভিত্তি

জামায়াতে ইসলামী মনে করে, একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মান উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলটি বহুবার ঘোষণা দিয়েছে— তারা ক্ষমতায় গেলে স্বাস্থ্যসেবা দেশেই নিশ্চিত করবে, কোনো মন্ত্রী বা জনপ্রতিনিধি বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাবেন না।

এই বক্তব্যের মূলে রয়েছে এক বাস্তবধর্মী বার্তা: দেশের সম্পদ ও অবকাঠামো যদি জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা হয়, তবে রাষ্ট্র নিজেই আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য— এই দুই খাতকে দলটি মানবিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখে, যা সমাজে ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তি স্থাপন করে।

যুবসমাজের প্রতি অঙ্গীকার

দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং হতাশাগ্রস্ত যুব সমাজের জন্য জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচির কথা বলেছে। দলটির নীতিতে উল্লেখ রয়েছে, যুবকদের জন্য “কর্জে হাসানা”— অর্থাৎ সুদবিহীন ঋণব্যবস্থা চালু করা হবে, যাতে তারা আত্মনির্ভর হতে পারে এবং সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

এটি মূলত একটি মানবিক অর্থনৈতিক ধারণা, যেখানে সমাজের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে যুব সমাজকে দেখা হয়— ভোট ব্যাংক হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্র গঠনের সহযোগী হিসেবে।

রাজনীতিতে নৈতিকতার পুনর্জাগরণ

জামায়াতে ইসলামী মনে করে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে নৈতিকতার অভাব। ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি, লুটপাট ও সুবিধাভোগের সংস্কৃতি আজ জনগণের আস্থা কেড়ে নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দলটি নৈতিক নেতৃত্ব ও দায়বদ্ধ রাজনীতির আহ্বান জানাচ্ছে।

তাদের দৃষ্টিতে, রাজনীতি কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্র নয়, বরং একটি আমানত— জনগণের সেবা করার পবিত্র দায়িত্ব। যদি নেতৃত্ব নৈতিকতাশূন্য হয়, তবে উন্নয়নও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

মানবিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী তাদের মানবিক ও কল্যাণভিত্তিক দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে কি না— সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে এটি স্পষ্ট যে, দলটি এখন আর কেবল ধর্মীয় আদর্শের প্রতীক নয়; বরং তারা রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের এক বিকল্প মডেল তুলে ধরতে চাইছে।

যে রাজনীতি দুর্যোগে মানুষের পাশে থাকে, দারিদ্র্য মোকাবেলায় উদ্যোগ নেয়, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে— সেই রাজনীতিই সময়ের দাবি।

উপসংহার

আজকের বাংলাদেশে মানবিক রাজনীতি একটি প্রয়োজন, বিলাসিতা নয়। সমাজে বৈষম্য, দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয়ের এই সময়ে জামায়াতে ইসলামী যে “মানবিক সংগঠন ও মানবিক রাষ্ট্র” ধারণা সামনে এনেছে, তা রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।

যদি এই দর্শন বাস্তবে রূপ পায়, তবে এটি দেশের রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে— যেখানে নেতৃত্ব মানে সেবা, রাজনীতি মানে মানবতা, আর রাষ্ট্র মানে সবার জন্য সমান মর্যাদা ও সুযোগের নিশ্চয়তা।

সব সংবাদ