Dawatul Islam | ফেসবুকের ‘জিহাদ’: যেখানে থামছে না বোকামির মহাযুদ্ধ

বুধবার, ০৮, অক্টোবর, ২০২৫ , ২২ আশ্বিন ১৪৩২

আপনার দাওয়াহের বার্তাকে পৌঁছে দিন বিশ্বময়
একটি প্রফেশনাল ও আধুনিক ইসলামী ওয়েবসাইটের মাধ্যমে
বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
ইসলামী শিক্ষার সাথে থাকুন
ইসলামিক বক্তা, খতিব, শিক্ষক...গণের জন্য ওয়েবসাইট
এখানে ক্লিক করুন
সমাজসেবা কার্যক্রমে অংশ নিন
আপনার কষ্টার্জিত বয়ান আজীবন ধরে রাখুন
আরও জানুন
ফেসবুকের ‘জিহাদ’: যেখানে থামছে না বোকামির মহাযুদ্ধ
০৬ জুন ২০২৫ ১২:৫৮ মিনিট

আজকাল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় ফেসবুকে। যুদ্ধের নাম ‘জিহাদ’। তবে যুদ্ধটা কোনো সামরিক অভিযান নয়, বরং হচ্ছে এক অবিশ্বাস্য ডিজিটাল নাটক—যেখানে তলোয়ার, বন্দুক আর বোমার বদলে ব্যবহৃত হয় ‘লাইক’, ‘শেয়ার’ আর ‘কমেন্ট’!

ফেসবুকের News Feed হলো সেই মঞ্চ, যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন লড়াই করে নিজেদের মতামত, বিরোধিতা, অভিযোগ আর কখনো কখনো গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এই ‘জিহাদ’ কখনো নীরব, কখনো রোমাঞ্চকর, আর কখনো পরকীয়া নাটকের মতো রঙ্গিন ও নাটকীয়। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় তথ্যের সত্যতা নিয়ে নয়, বরং কত দ্রুত একটি অবাস্তব কথা ভাইরাল করা যায়, সেটাই মূল লক্ষ্য।

এখন ‘ইহুদি’ শব্দটি হয়ে গেছে ফেসবুকের এক রকম মজার ট্যাগ। যাকে দিয়ে ‘বিশ্বজুড়ে ষড়যন্ত্রের মুখোশ’ হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করা হয়—অর্থাৎ, যেকেউ, যেকোনো বিষয়েই ‘ইহুদি’ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যদি কেউ একটু ভিন্নমত পোষণ করে! কিন্তু এসব ‘ইহুদি জিহাদ’ যুদ্ধে কেউ বলবে না, আসলেই কি সত্যি কোন ষড়যন্ত্র আছে? না, এই যুদ্ধটা তো আসলে চলছে ‘শেয়ার’ আর ‘রিঅ্যাকশন’ এর পেছনে, যেখানে কেউ তথ্য যাচাই করে না, শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যকে ‘তাড়ানোর’ জন্য।

এই ‘জিহাদের’ সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো—ফেক নিউজ। একটি ছবির নিচে অর্ধেক তথ্য, অন্যদিকে একটা বিকৃত কাহিনী, আর সাথে ঢেলে দেওয়া অতিরঞ্জিত মন্তব্য—এগুলো একসাথে মিলে এমন এক ডিজিটাল বোমা সৃষ্টি করে যা瞬間ে ভাইরাল হয়। পরে সবাই মুখ ফুঁড়ে বসে ‘আমার দেশে এটা চলবে না’, ‘আমাদের ধর্ম বিপন্ন’, এমন কত কিছু বলে, যেখানে আসল ঘটনা কেউ পড়েই না।

এভাবে একসময় ফেসবুক হয়ে ওঠে ডিজিটাল যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে কেউ রণকৌশল জানে না, শুধু মোবাইল হাতে ধরে ‘শেয়ার’ আর ‘কমেন্ট’ ছুঁড়ে দেয়। “আমি তো শেয়ার করলাম, আমার দায়িত্ব শেষ!”—এই কথা যেন যুদ্ধের ঘোষণার মত। অথচ আসল ‘যুদ্ধ’ হয় তথ্যের সাথে, যেখানে যুক্তি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয়।

আর এই ‘ডিজিটাল যুদ্ধের’ সবচেয়ে মজার দিক হলো, সবাই নিজেকে মনে করে ‘সেনাপতি’। তারা সবাই ফেসবুকে যুদ্ধের ‘সুপারস্টার’। কেউ হয় ‘ডিজিটাল সেনা’, কেউ ‘নেটওয়ার্ক কমান্ডার’, আবার কেউ ‘ম্যাশরুম ট্যাঙ্ক’! কিন্তু বাস্তবে, অনেক সময় আমরা যেন একটি নাটকের অংশ, যেখানে সকলেই অভিনয় করছেন—কেউ জানেনা প্লে’র স্ক্রিপ্ট, কেউ বুঝতে পারে না নাটকের অর্থ।

এই যুদ্ধ কখনো থামে না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলতে থাকে ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানো, ‘শেয়ার’ করা, ‘রিঅ্যাকশন’ করা, আর কারো স্ট্যাটাসে কটাক্ষ করা। আর এসব চলতে থাকে যেভাবে বৃষ্টি, কোনো থামার নামই নেয় না। কেউ যদি একটু থামার চেষ্টা করে, তার ক্ষেত্রেও হয় ‘তালিবানি’ মন্তব্য, ‘সন্ত্রাসী’ অপপ্রচার, কিংবা ‘রবিবার থেকে নেটওয়ার্ক ডাউন’ টাইপের কটূক্তি!

আসলে এই ‘জিহাদ’ আমাদের শেখায় ডিজিটাল যুগের একটা অদ্ভুত সত্য—কীভাবে আমরা সবাই নিজেদের অজ্ঞতা ঢাকতে চাই, কিভাবে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্তিশালী মনে করতে চাই। আমরা প্রত্যেকেই চাই ‘বড় সেলিব্রিটি’ হতে, চাই ‘ভাইরাল’ হতে। কিন্তু মাঝে মাঝে ভুল তথ্যের মুখে আমরা নিজেদের সত্যিকারের দায়িত্ব ভুলে যাই—যা হলো চিন্তা করা, যাচাই করা, এবং বুঝে শেয়ার করা।

এই যুদ্ধে যাদের সবচেয়ে ক্ষতি হয়, তারা হলো সাধারণ মানুষ, যারা বিভ্রান্ত হয়, আতঙ্কিত হয়, এবং ভুল পথে চলে যায়। আর আমাদের সমাজের বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মানুষরা হয়ে পড়ে বিরক্ত ‘নিরীহ দর্শক’, যাঁরা চুপচাপ বসে দেখে যাচ্ছেন ডিজিটাল যুদ্ধের এই বিশৃঙ্খল দৃশ্য।

তবে আমরা কি করব? প্রযুক্তি থামানো যাবে না। কিন্তু আমরা বুদ্ধি আর সততা নিয়ে ফেসবুকে ‘জিহাদের’ মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি। তথ্য যাচাই করবো, অন্ধ বিশ্বাসে ভুগবো না, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—অন্যকে বিভ্রান্ত করবো না। কারণ, সত্যিই এই যুদ্ধে জয়ী হবেন শুধু যারা ‘তথ্য’ আর ‘বুদ্ধিমত্তা’ এর অস্ত্র হাতে নেবে।

তাই, পরবর্তীবার যখন ফেসবুকে ‘জিহাদের ডাক’ শুনবেন, একটু থামুন। মজা করুন, হাসুন, কিন্তু মাথা ঠান্ডা রাখুন। আর মনে রাখবেন, ডিজিটাল যুদ্ধ হয় মুখোশ ছাড়া, সরাসরি যুক্তি আর সত্যের কাছে।

আমরা সবাই এই ‘ডিজিটাল যুদ্ধের’ সৈনিক, কিন্তু হোক আমাদের অস্ত্র বুদ্ধি আর সততা, বোকামি নয়।

ডিজিটাল মঞ্চে বোকামির মহাযুদ্ধের এক মহাকাব্য

আমাদের যুগের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ এখন আর কোন সামরিক যুদ্ধ নয়, না বন্দুক বা বোমার আঘাতে হয়। যুদ্ধ চলছে আমাদের হাতের মুঠোফোনে, চোখের সামনেই থাকা ছোট ছোট স্ক্রিনে। এই যুদ্ধের নাম ‘ফেসবুকের জিহাদ’। আর এখানে অস্ত্র কোনো শত্রুকে মারার জন্য নয়—এখানে যুদ্ধে জেতার পদ্ধতি হলো যত দ্রুত সম্ভব গুজব ছড়িয়ে দেওয়া, যত বেশি লোককে বিভ্রান্ত করা এবং যত তীব্র ‘রিঅ্যাকশন’ পাওয়া।

ফেসবুকের এই ‘জিহাদ’ মূলত এক ধরনের ডিজিটাল থিয়েটার। এখানে সবাই অভিনেতা, সবাই পরিচালক, কেউ কেউ এমনকি প্রযোজকও। শুধু সত্য আর যুক্তি ছাপিয়ে গেলেন এই মঞ্চ থেকে। এখন তো ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’, ‘শেয়ার’ আর ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ ই হলো যুদ্ধের গোলাপি গোলাগুলি।

অবাক করার মতো বিষয় হলো—এখানে কেউ বুকে তলোয়ার বেঁধে নেই, কিন্তু প্রায়ই চোখের সামনে মনের যুদ্ধ লড়াই হয়। মুখের হাসি মিষ্টি, কিন্তু কমেন্টে কাঁটা মিশ্রিত কথার গোলাপবাগান! একজন লিখলেন, “দেশটাই শেষ হয়ে যাবে,” আর আরেকজন বলল, “তোমার মত দুশমন বেশি!” এরকম সংঘর্ষ চলছে, যাদের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই, শুধু ভার্চুয়াল টুপি আর ভয়ঙ্কর পোষ্টার।

এখানে ‘ইহুদি’ শব্দটা একটা বিশেষ ক্লাসিক্যাল মেমে হিসেবে পরিণত হয়েছে। ‘ইহুদি’ হলো এখন এক ধরনের অলৌকিক শব্দ, যা ব্যবহার করলে মুহূর্তে পোস্টে মহাকাব্যিক রকমের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কোনো ফ্যাক্ট চেকিং নেই, কোনো যুক্তি নেই—শুধু চেহারা বদলে বদলে ‘ইহুদি’ শব্দ ছুঁড়ে মারার খেলা! এই শব্দ দিয়ে প্রায়শই তৈরি হয় যুদ্ধের অদ্ভুত ধরনের জঙ্গি। ‘ইহুদি’র সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে যেভাবে প্রাচীন গল্পের মতো, কিন্তু এখানে গল্পের চেয়েও বেশি নাটক।

আর যুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো ‘ফেক নিউজ’। একবার একটি ঝামেলাজনক খবর ছড়িয়ে পড়ল, আর তার ওপর নানা বাটপার, ষড়যন্ত্রের থিয়োরি গড়ে উঠল! কেউ যাচাই করতে চায় না, কারণ যাচাই করতে গিয়ে তো ঝামেলা। ‘শেয়ার’ করলেই দায়িত্ব শেষ, পরবর্তী ধাপ হলো ‘ক্লিকবেট’ আর ‘ড্রাম্যাটিক’ কমেন্টের বন্যা। সবাই একে অপরকে ‘বোকা’ বলছে, আবার নিজেরাই হাসছেন, কারণ জানেন না কে আসল বোকা!

এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো, অংশগ্রহণকারীদের একদম কম শতাংশ সত্যি জানতে চায় বা বুঝতে চায়। তারা আসলে ‘বিজ্ঞানী’ নয়, তারা ‘মিথ্যার যোদ্ধা’। আজকের যুগে জ্ঞান আর তথ্যের চেয়ে ‘হাউ-টু-বাকশ্যাল মিডিয়া’ অনেক বেশি জনপ্রিয়। সবাই চায় দ্রুত ভাইরাল হতে, আর ভাইরাল হওয়ার জন্য যা লাগে তাই করবে—সত্য, মিথ্যা, উভয়ই।

আর এই ‘ডিজিটাল যুদ্ধের’ সবচেয়ে হাস্যকর অংশ হলো যে যোদ্ধারা নিজেদের ‘সেনাপতি’ মনে করে। তারা ভেবেছে ‘লাইক’ আর ‘শেয়ার’ তাদের ক্ষমতা। কিন্তু আসলে, এরা সবাই নাটকের মঞ্চে নিজেদের ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করছেন—তাদের কেউ স্ক্রিপ্ট জানেনা, কেউ বুঝেনা মঞ্চের পর্দার বাইরে কি হচ্ছে।

এই যুদ্ধে সত্য, বুদ্ধি, যুক্তি কিংবা সম্মান কোথায়? অনেক সময় এসব বাদ পড়ে যায়, আর ফিরে আসে মিথ্যার কুয়াশা আর বিভ্রান্তির অন্ধকার। আর এই বিভ্রান্তির কুয়াশায় পড়ে যায় পুরো সমাজ। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়, তারা আতঙ্কিত হয়, তারা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। আর যাদের সত্য জানা দরকার, তারা হয় গুমরে গুমরে, কিংবা ঘরে বসে হাসে এই ‘বোকামির যুদ্ধ’ দেখিয়ে।

তবে আশা এখনও টিকে আছে—যুদ্ধ থামবে যদি আমরা একটু বুঝদার হই। ফেসবুকের ‘জিহাদ’র মোকাবেলা হবে তখন, যখন আমরা নিজেরা তথ্য যাচাই করব, বুঝে শুনে শেয়ার করব, আর অন্ধ বিশ্বাসে ভোগব না।

পরিশেষে, মনে রাখবেন—এই ‘ডিজিটাল যুদ্ধ’ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের প্রয়োজন বুদ্ধি, ধৈর্য আর সততা। একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগোতে হবে, যেন আমরা বোকামির মহাযুদ্ধে হার না যাই

সত্যিকারের ‘জিহাদ’ তো হলো নিজের মনের অন্ধকার দূর করা, আর সেটা কখনো হয় না অন্ধকার ছড়ানো দিয়ে। তাই থাকুন আলোকিত, সচেতন আর বুদ্ধিমান। আর ফেসবুকে ‘জিহাদের ডাক’ শুনলে একটু হাসুন, একটু থামুন, আর নিজেকে বলুন—“আসলে আমি কি সত্যিই এই যুদ্ধে লড়ছি, নাকি শুধু একটি ডিজিটাল নাটকের অংশ?”

 

সব সংবাদ