ডিজিটাল যুগে মুসলমানের দায়িত্ব ও করণীয়: এক বিস্তৃত আর্টিকেল
মাওলানা মুহাম্মদ রফিক আহমদ
গত ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ চট্টগ্রামের আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাম্মদ রফিক আহমদ ৮৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি এ মাদরাসার সাবেক শাইখুল হাদিস আল্লামা ইমাম আহমদ (রহ.)-এর ছেলে ছিলেন। মাওলানা রফিক আহমদ ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের চাঁন্দগাঁও থানার মোহরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৬৭ সালে পটিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। ১৯৭৪ সালে নানুপুর ওবাইদিয়া মাদারাসায় দাওরায়ে হাদিস শুরু করা হলে তিনি তাতে মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে তিনি পটিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে তিনি হাদিস ও তাফসির বিষয়ক পাঠদানের পাশাপাশি ছাত্রাবাস তত্তাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা মুহাম্মদ নুরুদ্দিন ফতেহ্পুরী
১৭ জানুয়ারি ২০২৩ শিলালিপি গবেষক ও ভাষাবিদ মাওলানা মুহাম্মদ নুরুদ্দিন ফতেহ্পুরী ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন শিলালিপি গবেষক, আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষার পণ্ডিত এবং ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ গ্রণয়ন কমিটির অন্যতম সম্পাদক। গত শতকের আশির দশকে তিনি বিভিন্ন স্থানের অপ্রকাশিত শিলালিপির পাঠ উদ্ধার শুরু করেন।
২০১০ সাল থেকে তিনি ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির শিলালিপি বিষয়ক প্রকাশিতব্য গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। তিনি ১৯৪৮ সালে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের মুক্তারপুর ইউনিয়নের পোটন (ফতেহ্পুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার বড় কাটরা মাদরাসার পড়ার পর তিনি পাকিস্তানের দারুল উলুম করাচি এবং লাহোরের জামেয়া আশরাফিয়ায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি বড় কাটরা মাদরাসা ও খাজে দেওয়ান লেন মহিলা মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ঢাকার বড় ভাট মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘বিন্দুবিহীন বর্ণে মহানবী (সা.)’ ‘বিন্দুবিহীন বর্ণে বাংলাদেশ’, ‘কুন্তু লা আদরী’ (উর্দু ভাষায় লেখা গল্প গ্রন্থ), শেখ সাদির কাব্য ‘কারিমা’ (অনুবাদ), সুফী কবিতার সংকলন ‘জজবায়ে মারেফত’ (অনুবাদ) ইত্যাদি অন্যতম।
মাওলানা মুমতাজুল করিম (বাবা হুজুর)
গত ২৭ মার্চ ২০২৩ চট্টগ্রামের দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার প্রবীণ শিক্ষক মাওলানা মুমতাজুল করিম ‘বাবা হুজুর’ ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি দীর্ঘ ৩৯ বছর (১৯৮৪-২০২৩) এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা হাদিস অধ্যাপনা করেন। মাওলানা মুমতাজুল কারিম ১৯৪২ সালে কুমিল্লার সদর দক্ষিণ থানার ডুলিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বটগ্রাম হামিদিয়া মাদরাসা, ফেনী শর্শদি মাদরাসা, হাটহাজারী মাদরাসায় পড়েন। সর্বশেষ পটিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তানের জামিয়া আশরাফিয়া লাহোর থেকে তাফসির ও আদব (আরবি সাহিত্য) বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে দেশে ফিরে তিনি ময়মনসিংহের কাতলাসেন কাদেরিয়া কামিল মাদরাসা, বরিশালের চরমোনাই মাদরাসা, ঢাকার বড়কাটারা মাদরাসায় হাদিসের শিক্ষকতা করেন। এরপর চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে সাত বছর শিক্ষকতা করেন। ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জামিয়া হোসাইনিয়ার প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯৮৪ সালে হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ছাত্ররা তাকে ‘বাবা হুজুর’ বলে সম্বোধন করতেন।
মাওলানা শিব্বির আহমদ
গত ২৯ মার্চ ২০২৩ নোয়াখালীর প্রবীণ আলেম মাওলানা শিব্বির আহমদ ৮৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি কওমি মাদরাসার শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন। তিনি নোয়াখালীর দারুল উলুম চরমুটুয়া মাদরাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মাওলানা শিব্বির আহমদ (রহ.) ১৯৩৬ সালে নোয়াখালীর দক্ষিণ মহতাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লক্ষ্মীপুরের জামিয়া ইসলামিয়া কলাকোপায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। কর্মজীবনে রাওলদিয়া দারুল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসা, তিতাকান্দি আলিয়া মাদরাসা, ফেনীর বাদাদিয়া মাদরাসা ও চর মানসা মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। এরপর দারুল উলুম আল ইসলামিয়া চরমটুয়া মাদরাসায় একাধারে ৪৮ বছর শিক্ষকতা করেন। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে দেশের অসংখ্য আলেমকে তিনি আরবি ব্যাকরণ (নাহু ও সরফ) প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
মুফতি নূর আহমদ
গত ৩১ মার্চ ২০২৩ হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান মুফতি ও প্রবীণ মুহাদ্দিস আল্লামা নূর আহমদ ৯০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক পরিচালক আল্লামা শাহ হামেদ (রহ.)-এর বড় জামাতা ছিলেন তিনি। মুফতি নূর আহমদ (রহ.) ১৯৩৮ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন। এরপর প্রায় আড়াই বছর তৎকালীন মুফতিয়ে আজম মুফতি ফয়যুল্লাহ (রহ.)-এর সান্নিধ্যে ফিকাহ ও ফতোয়া বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্ব অর্জন করেন। মুফতি ফয়যুল্লাহ (রহ.) হাটহাজারী মাদরাসার তৎকালীন পরিচালক আল্লামা শাহ আবদুল ওয়াহ্হাব (রহ.)-এর কাছে একটি চিঠি লিখে পাঠালে মুফতি নূর আহমদকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে দুই বছর পর তিনি মাদরাসা থেকে অব্যাহতি নেন। মুফতি ফয়যুল্লাহ (রহ.)-এর সুপারিশে তিনি দুই বছর হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। এরপর দীর্ঘ ২০ বছর বাথুয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৮৪ সাল থেকে দীর্ঘ ৩৮ বছর হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন।
মাওলানা আব্দুল গণী
গত ২৯ নভেম্বর ২০২৩ রাজধানীর ফরিদাবাদ মাদরাসার প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল গণী ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ২০১৬ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরের ভারতে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এরপর গত কয়েক মাস যাবত তিনি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
মাওলানা আবদুর রউফ
গত ৭ ডিসেম্বর ২০২৩ গওহরডাঙ্গা মাদরাসার প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুর রউফ (ঢাকার হুজুর) ইন্তেকাল করেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক ও শায়খুল হাদিস ছিলেন। তিনি আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর শিষ্য ও করাচির হজরত আল্লামা হাকিম আখতার (রহ.)-এর খলিফা ছিলেন। গওহরডাঙ্গা মাদরাসাসহ দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় হাদিস গ্রন্থ সহিহ বুখারির পাঠদান করতেন।
মুহাম্মদ হামিদুর রহমান (প্রফেসর হজরত)
গত ২ নভেম্বর ২০২৩ ইসলামী ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ হামিদুর রহমান ইন্তেকাল করেন। তিনি মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) ও মাওলানা শাহ আবরারুল হক (রহ.)-এর খলিফা ছিলেন। এ ছাড়া দেশের আলেমসমাজের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। কর্মজীবনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক থাকলেও পরবর্তী সময়ে নিজেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিযুক্ত করেন। মুহাম্মাদ হামিদুর রহমান ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলে পড়ার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত মক্তবে পড়তেন এবং মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের সেবা করতেন। ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের শুরুতেই তাঁর বাবা ইয়াসিন (রহ.) মারা যান। ১৯৫৭ সালে তিনি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট) ভর্তি হন। কর্মজীবনে তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কম্পানিতে চাকরি করেন। ১৯৬৫ সালে প্রশিক্ষণ নিতে ইংল্যান্ডে যান এবং ফিরে এসে দাড়ি রাখা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে কম বেতনে বুয়েটে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন।
১৯৭৪ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন। পাঁচ বছর পর তিনি খিলাফত লাভ করেন। ১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সফরসঙ্গী হিসেবে পবিত্র হজ পালন করেন। ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। তখন বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছুটি দিতে না চাইলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। সফর থেকে দেশে ফেরার পর হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) তাঁকে মাদরাসায় পড়ে আলেম হওয়ার পরামর্শ দেন এবং মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। পরবর্তীতে মাদরাসা করলেও পুরোপুরি মাদরাসায় পড়তে না পারায় তিনি সবসময় আক্ষেপ করতেন। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।